সূচনা : করুণাময় দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু। প্রশংসার মালিক কেবলই তিনি। অনুকম্পা ও শান্তি বর্ষিত হোক তার রাসূল, মানবজাতির মহান শিক্ষক মুহাম্মাদ (ছাঃ) এবং তাঁর পরিবার ও ছাহাবীদের উপর। শিক্ষকতাকে একটি মহৎ ও মানবিক পেশা হিসাবে গণ্য করা হ’লেও শিক্ষণ-শিখন প্রক্রিয়া অনেক জটিল কাজ। শিক্ষকের অর্জিত বিদ্যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে কাঙ্খিত মান অনুযায়ী সঞ্চারিত করা খুব সহজ কথা নয়। এজন্য শিক্ষককে যেমন দায়িত্ব সচেতন হ’তে হবে তেমনি শিক্ষার্থীদেরও শিক্ষাগ্রহণে যথাসম্ভব আগ্রহী করে তুলতে হবে। যেসব শিক্ষার্থী নিজের বিদ্যাবুদ্ধির উত্তরোত্তর উন্নতি ঘটাতে আপনা থেকেই প্রয়াসী তাদের মেধা দ্রুতই বিকশিত হয়। কিন্তু যাদের মাঝে শিক্ষাগ্রহণে অনাগ্রহ পরিলক্ষিত হয় তাদের মাঝে প্রেষণা সৃষ্টিতে শিক্ষকের ভূমিকা অগ্রগণ্য। তাই শিক্ষককে তার নিজের মৌলিক দায়িত্ব ও কর্তব্য যেমন জানা দরকার, তেমনি শিক্ষার্থীদের মাঝে পাঠদানের ফলপ্রসূ পদ্ধতিও জানা দরকার।
শিক্ষণ-শিখনকে অধিকতর ফলপ্রসূ করতে পাঠের আচরণিক উদ্দেশ্য ও শিখনফল সামনে রেখে পাঠদান করা কর্তব্য বলে বর্তমান শিক্ষাবিদরা মনে করেন। ঈপ্সিত শিখনফল শিক্ষার্থীদের মাঝে ফুটিয়ে তুলতে পারলে শিক্ষকের পাঠদান আশানুরূপ হচ্ছে বলে আশা করা যায়। প্রত্যেকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চায় মানসম্মত পাঠদানের মাধ্যমে তাদের শিক্ষার্থীদের সার্বিক মানের অগ্রগতি। তারা যাতে দ্বীনদার ও চরিত্রবান হয়ে গড়ে ওঠে এবং প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে দক্ষতার সাথে নিজেদের অভিযোজিত করতে পারে এবং কর্মক্ষেত্রে নিজেদের সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী মেধার স্বাক্ষর রাখতে পারে সেটাই থাকে একটি আদর্শ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য। এ লক্ষ্য অর্জনে প্রতিষ্ঠান স্বভাবতই শিক্ষককদের উপর বেশী নির্ভর করে। তাই শিক্ষায় নিজের ও শিক্ষার্থীদের মানোন্নয়নে শিক্ষককে প্রশিক্ষণসহ শিক্ষার নানাদিক আয়ত্ব করে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে হয়। এ লক্ষ্যে আলোচ্য নিবন্ধে শিক্ষকের মৌলিক দায়িত্ব ও কর্তব্য, শিশুর পাঠদান পদ্ধতি ও শিখনফল নির্ণয়ের কিছু দিক তুলে ধরা হ’ল।
শিক্ষকের মৌলিক দায়িত্ব ও কর্তব্য : শিক্ষক শ্রেণীকক্ষের প্রাণ। তাকে ঘিরেই পঠন-পাঠন প্রক্রিয়া আবর্তিত হয়। তাই তার দায়িত্ব-কর্তব্যও অনেক। এসব দায়িত্বের কিছু ব্যক্তিগত, কিছু প্রতিষ্ঠান-প্রশাসন কেন্দ্রিক, কিছু শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক এবং কিছু সহকর্মী কেন্দ্রিক। শিক্ষকের মৌলিক কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য এখানে তুলে ধরা হ’ল-
ব্যক্তিগত দায়িত্ব-কর্তব্য :
১. শিক্ষক সময়নিষ্ঠ হবেন। সময় মত প্রতিষ্ঠানে হাযির হবেন এবং ছুটির পর প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করবেন।
২. পেশাগত উন্নয়নের জন্য প্রশিক্ষণ নিবেন এবং গৃহীত প্রশিক্ষণ কাজে লাগিয়ে পাঠদান করবেন।
৩. শিক্ষা সংক্রান্ত আধুনিক কলাকৌশল যেমন আই.সি.টি. ইত্যাদিতে পারদর্শিতা অর্জন করবেন।
৪. মাল্টিমিডিয়া ক্লাস গ্রহণে দক্ষতা অর্জন করবেন।
৫. পাঠটিকা প্রণয়ন করবেন এবং তদনুসারে ক্লাস নিবেন।
৬. সকল শিক্ষাগত ও অভিজ্ঞতার সনদপত্র যত্ন সহকারে ফাইলে সংরক্ষণ করবেন।
৭. নিজের চাকুরির নিয়োগপত্র, যোগদানপত্র, চাকুরিবহি, বদলি অর্ডারপত্র, অব্যাহতিপত্র, বদলিকৃত প্রতিষ্ঠানের যোগদানপত্র, প্রশিক্ষণ সনদ, স্কেল পরিবর্তনের কাগজ, এককথায় চাকুরির ধারাবাহিক সকল রেকর্ডপত্র সংরক্ষণ করবেন।
৮. তিনি হবেন একজন পড়ুয়া। সব রকম জ্ঞান অর্জনে তিনি সদা সচেষ্ট থাকবেন।
৯. পারিবারিক, সামাজিক ও দ্বীনী ক্ষেত্রে সকলের সাথে মিলেমিশে কাজ করবেন।
১০. মানুষ ও অন্যান্য জীবের অধিকার ক্ষুণন করবেন না।
১১. আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য হবে তার জীবনের ব্রত।
প্রতিষ্ঠান-প্রশাসন কেন্দ্রিক দায়িত্ব-কর্তব্য :
১. কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করবেন।
২. কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতীত কর্মস্থল ত্যাগ করবেন না এবং কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকবেন না।
৩. নৈমিত্তিক ছুটিসহ যে কোন ছুটির জন্য কর্তৃপক্ষকে আগেভাগে জানাবেন এবং ছুটি মঞ্জুর করে নিবেন।
৪. চাকুরি সংক্রান্ত নিজের প্রয়োজন ও সুবিধা-অসুবিধার কথা প্রতিষ্ঠান প্রধানকে জানাবেন।
৫. প্রতিষ্ঠান প্রধান, ব্যবস্থাপনা পরিষদ ও উর্ধতন কর্তৃপক্ষের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখবেন। কোন কারণে মনোমালিন্য হ’লে তা মিটিয়ে ফেলতে চেষ্টা করবেন।
৬. বেতন বিল সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ যথাসময়ে সম্পন্ন করবেন এবং সময় মত তা গ্রহণ করবেন।
৭. হাযিরা বহি থাকলে তাতে যথাসময়ে স্বাক্ষর করবেন এবং ডিজিটাল হাযিরা থাকলে তাতে টিপ দিবেন।
৮. প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ যখন যে নির্দেশ দিবেন তখন সেই নির্দেশ পালন করবেন।
৯. মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর এবং শিক্ষাবোর্ডের নির্দেশনা মেনে চলবেন।
১০. অফিস থেকে তার কাছে কোন কাগজপত্র পূরণ করে দিতে বললে তা যথারীতি পূরণ করে দিবেন।
১১. প্রতিষ্ঠানের অফিসের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখবেন এবং প্রতিষ্ঠানে এসে প্রধানের সঙ্গে দেখা করবেন; যাওয়ার সময় বলে যাবেন।
১২. সময় মত এ.সি.আর. পূরণ করে অফিসে জমা দিবেন। (সরকারী চাকুরীজীবিদের ক্ষেত্রে)
শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক দায়িত্ব-কর্তব্য :
১. ক্লাস রুটিন অনুযায়ী সময় মত শ্রেণীকক্ষে হাযির হবেন এবং নির্ধারিত সময়ে শ্রেণীর কার্যক্রম শেষ করবেন।
২. শিক্ষার্থীদের নাম হাযিরা করবেন।
৩. শিক্ষার্থীদের নাম, ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর ডায়েরিতে লিখে নিবেন।
৪. পাঠ দানের বিষয় নিজ ডায়রীতে লিখে রাখবেন। যেন পাঠদান করতে গিয়ে কোথায় পড়া তা শিক্ষার্থীদের কাছে জিজ্ঞেস করতে না হয় এবং পূর্বপ্রস্ত্ততি ছাড়াই পাঠদান করা না হয়।
৫. বিএড/এমএড প্রশিক্ষণ থেকে লব্ধ জ্ঞান অনুযায়ী শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক পাঠদান করবেন। যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের পাঠ গ্রহণে সবসময় সক্রিয় থাকে।
৬. শিখনফল অর্জিত হচ্ছে কি-না তা মূল্যায়ন করবেন।
৭. তার ক্লাসগ্রহণ যেন আনন্দঘন হয়,যান্ত্রিক না হয় সেদিকে খেয়াল রাখবেন।
৮. পাঠ আয়ত্ব করার কৌশল শিখাবেন।
৯. শিক্ষার্থীদের কারও প্রতি বিদ্বেষ এবং কারও প্রতি পক্ষপাতিত্ব করবেন না।
১০. পরীক্ষার উত্তরপত্র যথাসময়ে মূল্যায়ন করে পরীক্ষার ফলাফল তৈরি করবেন।
১১. মূল্যায়নকালে তিনি নৈর্ব্যক্তিক থাকবেন। কাউকে কম এবং কাউকে বেশী নম্বর দিবেন না।
১২. পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করার কৌশল শিখাবেন।
১৩. শিক্ষার্থীদের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করবেন, নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করবেন না।
১৪. শিক্ষার্থীর অসদাচরণ কিংবা পড়া না পারার জন্য দৈহিক ও মানসিক শাস্তি দিবেন না। ভালোবেসে সংশোধনের চেষ্টা করবেন।
১৫. শিক্ষার্থীদের জ্ঞানস্পৃহা বাড়াতে তাকে প্রশ্ন করতে দিবেন এবং তিনি উত্তর দিতে চেষ্টা করবেন।
১৬. তাদের বিভিন্ন ভাষা শিখতে অভিধান ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করবেন।
১৭. শিক্ষার্থীদের জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গীর উন্নয়নে সচেষ্ট থাকবেন।
১৮. শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রেষণা সৃষ্টি করবেন।
১৯. পঠন-পাঠনে তাদের যথাযথ পরামর্শ ও নির্দেশনা প্রদান করবেন।
২০. তাদের পেশাগত দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করবেন।
২১. শিক্ষার্থীদের দৈহিক, মানসিক, সামাজিক ও আত্মিক বিকাশে কাজ করবেন।
২২. তাদের দ্বীন-ধর্ম পালন ও চরিত্র গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করবেন।
২৩. তাদের সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ করবেন।
২৪. তাদের সুখ-দুঃখ, ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যাদি জানা ও সমাধানের চেষ্টা করবেন।
২৫. ছোটদের স্নেহ, বড়দের সম্মান ও সমবয়সীদের সঙ্গে করণীয় আচরণ শিখাবেন।
২৬. শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, দ্বীনী ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনে সচেতন করবেন।
২৭. শিক্ষক শিক্ষার্থীদের জন্য একজন অনুকরণীয় আদর্শ মানুষ হবেন।
সহকর্মী কেন্দ্রিক দায়িত্ব-কর্তব্য :
১. সিনিয়রদের সম্মান, জুনিয়রদের স্নেহ এবং সমবয়সীদের ভালোবাসা জানাবেন।
২. তাদের সঙ্গে ভ্রাতৃসুলভ আচরণ করবেন।
৩. শিক্ষণ-শিখন বিষয়ে পারদর্শিতা ও দক্ষতা অর্জনে তাদের পরামর্শ নিবেন।
৪. প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রাখবেন।
৫. সকলের সুখে-দুখে সহমর্মিতা জানাবেন এবং যথাসাধ্য সহযোগিতা করবেন।
৬. প্রতিষ্ঠানের সকলে মিলে এক পরিবার হয়ে থাকবেন।
শিক্ষক তার এসব দায়িত্ব যথাসাধ্য পালন করলে ইনশাআল্লাহ তিনি শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও সমাজের মাঝে একজন গ্রহণযোগ্য ও প্রিয়ভাজন মানুষ হিসাবে বরিত হবেন। তার দ্বারা শিক্ষার্থীবৃন্দ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আশানুরূপ উপকৃত হবে।
শিশুর পাঠদান পদ্ধতি : যে কোন শিক্ষণ-শিখন কার্যক্রমের সঙ্গে যেমন প্রত্যক্ষভাবে পাঠ্যবিষয়/পাঠ্যবই, শ্রেণীকার্যক্রম, পাঠটীকা যুক্ত তেমনি পরোক্ষভাবে পাঠ্যক্রম ও পাঠপরিকল্পনার প্রয়োজন। শিশুর পাঠদান তথা শিক্ষণ-শিখন কার্যক্রমের সঙ্গেও বিষয়গুলো সমানভাবে জড়িত। নিম্নে এসব বিষয় সংক্ষেপে তুলে ধরা হল।
শিশুর পরিচয় : হাদীছ অনুসারে একজন মানুষ চন্দ্রবর্ষ অনুযায়ী ১৫ বছর বয়স না হওয়া পর্যন্ত শিশু। তারপর সে প্রাপ্তবয়স্ক। ইবনু ওমর (রাঃ) ১৪ বছর বয়সে অপ্রাপ্ত বয়স্কতার কারণে ওহোদ যুদ্ধে যোগদান করতে পারেননি। কিন্তু পরবর্তীতে ১৫ বছর বয়সে তিনি খন্দক যুদ্ধে যোগদান করেন (ছহীহ বুখারী, কিতাবুল মাগাযী, আহযাব যুদ্ধ আলহাদীছ এপস হা/৪০৯৭)। সাধারণত এ বয়সে শিশু শ্রেণী থেকে ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করা যায়। তবে অধিকাংশ দেশে ১৮ বছর বয়স না হওয়া পর্যন্ত শিশু গণ্য করা হয়। সে হিসাবে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থীরাও শিশু। কাজেই শিশুর পাঠদান পদ্ধতির আওতায় শিশু শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত শামিল হ’তে পারে।
শিশুর পাঠদান : শিশুদের শিক্ষণ-শিখন কার্যক্রমের অপর নাম শিশুর পাঠদান। শিশুকে কীভাবে পড়ালে পাঠদান ফলপ্রসূ হবে তা নিয়ে মনোবিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদরা অনেক গবেষণা করেছেন, করছেন এবং ভবিষ্যতেও করবেন। এ ক্ষেত্রে রুশো, পেস্তালৎসি, ফ্রয়েবল, হার্বাট, মন্তেসরী প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। এরা সবাই পাশ্চাত্যের মানুষ। আমরা তাদের শিক্ষানীতি ধার করে এনে নিজেদের দেশে চালু করি। অথচ দরকার এই মাটির সন্তানদের দ্বীন, চাহিদা, প্রয়োজনীয়তা ইত্যাদির আলোকে এ মাটির সন্তানদের দ্বারা গবেষণা ও উদ্ভাবন। হ্যাঁ, তাদের পদ্ধতির সাহায্য নেওয়া যাবে। কিন্তু মূল কাজ আমাদের মতো করে আমাদেরই করতে হবে।
যাহোক আমরা যে শিশুদের পড়াই বয়স ও শ্রেণীভেদে তাদের বই সরকারী পাঠ্যপুস্তক বোর্ড অথবা সংস্থা/ব্যক্তি বিশেষের লেখা। শিক্ষক হিসাবে বই নির্বাচনের দায় হ’তে শিক্ষকগণ এক প্রকার মুক্ত। তবে পাঠদান শ্রেণীশিক্ষককেই করতে হয়। আমরা জানি, পাঠদান ও পাঠগ্রহণ একটি সম্মিলিত কাজ বা টিম ওয়ার্ক। এর সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে আছেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীবৃন্দ এবং পরোক্ষভাবে আছেন অভিভাবক, সমাজ ও সরকার। শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের কাছে আমানত। তাদের যোগ্য মানুষ হিসাবে গড়ে তোলা তাদের দায়িত্ব। মুসলিম হিসাবে প্রত্যেক শিক্ষকের তার শিক্ষার্থীকে আল্লাহ ও তার রাসূলের পথের পথিক করে গড়ে তোলা এই আমানতদারির অংশ। শুধু পড়ানো নয়, বরং তাদের ঈমান-আকীদা ও ইবাদত-বন্দেগী আল্লাহর আদেশ ও রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাহ অনুযায়ী ছহীহ-শুদ্ধভাবে হচ্ছে কি-না তা শিক্ষকগণ পর্যবেক্ষণ করবেন এবং প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিবেন। তারা যাতে পারিবারিক ও সামাজিক ভাবে ইসলাম চর্চা করে, ইসলামের দাওয়াত দেয় সেভাবে তাদের গড়ে তুলবেন।
পাঠটীকা প্রণয়ন : শিশুর পাঠদান পদ্ধতির একটা অংশ পাঠটীকা প্রণয়ন। একজন শিক্ষকের প্রতিদিন প্রায় ৫-৬টা ক্লাস থাকে। ক্লাসের বাইরেও তাকে শ্রেণীপরীক্ষা মূল্যায়ন ও বাড়ির কাজ দেখতে হয়। তার ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক কাজও থাকে। কাজেই তার পক্ষে প্রতিটি বিষয়ের পাঠটীকা করা কষ্টকর। এজন্য তিনি একটা ডায়েরি বা নোটবুক রাখবেন। তাতে প্রয়োজনীয় নোট রাখবেন। তাতে উল্লেখ থাকবে- ১. তারিখ ২. শ্রেণী+বিষয়+প্রদত্ত পাঠ্যাংশ ৩. শিখনফল ৪. উপকরণ ৫. মূল্যায়নের প্রশ্ন ৬. ব্যবহারিক/ প্রদর্শন কার্য (যদি থাকে)। পাঠটীকা অনুযায়ী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রতিনিয়ত কিছু কাজ করতে হয়। যেমন- যে শ্রেণীর ক্লাসই হোক না কেন, শিক্ষক পড়ানোর জন্য পূর্বপ্রস্ত্ততি নিবেন। শিক্ষার্থীদেরও পূর্বপ্রস্ত্ততি নেওয়ার জন্য জোর তাগিদ দিবেন। বিগত পাঠ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ডায়েরিতে লেখা থাকবে। তদনুসারে সামনের পাঠের প্রস্ত্ততি নিবেন।
শিক্ষার্থীদের বুঝানোর জন্য পাঠদানের পূর্বেই শিক্ষক পাঠ্য অংশ কয়েকবার পড়ে দুর্বোধ্য অংশ ভালোভাবে বুঝবেন। প্রয়োজনীয় শিখনবস্ত্ত, শিখনকার্য ও শিখনফল নির্ণয় করবেন এবং মূল্যায়ন মূলক কিছু প্রশ্ন তৈরি করবেন।
পাঠটীকার মধ্য দিয়ে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পাঠদান শেষ করা সম্পর্কে তিনি নিশ্চিত হবেন। বাড়ির কাজ যেমন হাতের লেখা, রচনা, সৃজনশীল প্রশ্ন ইত্যাদির কোন একটি শিশুদের অবশ্যই দিবেন। এতে শিশুরা লেখা ও গঠনমূলক কাজে অভ্যস্ত হবে। তাদের হাতের লেখা সুন্দর হবে এবং বানান শুদ্ধ হবে। শিক্ষার্থীও আগামী ক্লাসের প্রস্ত্ততি আগেভাগে নিলে সে নিজ থেকে পাঠ্যাংশের অনেকখানি বুঝতে পারবে। সে নিজ সামর্থের উপর শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠবে। বাকী যেটুকু বুঝতে পারবে না তা তার হিসাবে থাকবে। শিক্ষকের পাঠদানের সময় সে তার না বুঝা স্থানে শিক্ষক কী বলেন তা বুঝতে চেষ্টা করবে। বুঝতে পারলে আর প্রশ্নের দরকার নেই। নচেৎ প্রশ্ন করে জেনে নিতে পারবে। এভাবে তার পড়া পূর্ণাঙ্গতা পাবে। শিক্ষক তার প্রস্ত্ততকৃত পাঠটীকা অনুযায়ী শ্রেণীকার্যক্রম পরিচালনা করবেন।
শ্রেণী শিখন কার্যক্রম : শ্রেণীশিখন কার্যক্রম শিক্ষকের মূল কাজ। এজন্য শিক্ষক নিম্নোক্ত কাজগুলো করবেন।-
শিক্ষক সালাম দিয়ে ক্লাসে প্রবেশ করবেন। শিক্ষার্থীরা সালামের জবাব দিবে। সুন্নাহ অনুসারে কম মানুষ বেশী মানুষকে সালাম দিবে। তবে ‘ছোটরা বড়দের সালাম দিবে’ এ হাদীছ অনুযায়ী ছাত্ররাও সালাম দিতে পারে। শিক্ষক শিক্ষার্থীদের ঠিকমত বসার ব্যবস্থা করবেন। মেধাবী, মধ্য মেধাবী ও স্বল্প মেধাবীদের একত্রে এক বেঞ্চে বসাবেন। হাযিরা খাতায় শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি নিবেন। ক্লাস ক্যাপটেন আগেই বাড়ির কাজ তুলে রাখবে। তিনি ক্লাসেই অথবা ক্লাসের বাইরে তা দেখবেন। মূল্যায়ন করে নম্বর দিবেন। ভুল থাকলে সংশোধন করবেন। ভুল এড়ানোর কৌশল শিখাবেন।
এরপর শিক্ষক বোর্ডে পাঠশিরোনাম লিখবেন এবং শিখন কাজের সময় বিভাজন করে পাঠটীকা অনুসারে পড়ান শুরু করবেন। ক্ষেত্রমত তিনি উপকরণ ব্যবহার করবেন। ভাষা শিক্ষা ক্লাসে শোনা, বলা, পড়া ও লেখার দক্ষতা যাতে বাড়ে সেভাবে শিক্ষার্থীদের প্রেষণা যোগাবেন। গ্রামার, কাওয়ায়েদ ও ব্যাকরণের ক্ষেত্রে বেশী বেশী উদাহরণ দিবেন। শিক্ষার্থীদের দিয়ে উদাহরণ তৈরি করাবেন। তারা উদাহরণ থেকে যাতে ব্যাকরণের সূত্র বা কায়দা-কানুন ধরতে পারে সে লক্ষ্যে তাদের দিয়ে অনুশীলন করাবেন।
প্রদর্শনযোগ্য বিষয় হ’লে ক্লাসের ভিতরে কিংবা বাইরে তার সঠিক নিয়ম করে দেখাবেন এবং ভুল নিয়ম পরিহার করতে বলবেন। যেমন, ওযু, ছলাত, জানাযা, কবর খনন, কাফন কাটা, বিবাহ পড়ান ইত্যাদি বাস্তবে করে দেখাবেন।
শিক্ষার্থীদের পড়ার ও কাজের সুযোগ দিবেন। ৪/৫ মিনিট তারা নীরবে পড়ে বুঝার চেষ্টা করবে এবং না বুঝলে কিংবা অধিকতর জানার জন্য তাদের প্রশ্ন করার সময় দিবেন। জিজ্ঞাসা বিদ্যার অর্ধেক। সুতরাং শিক্ষার্থীকে এ ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত না করে বরং আগ্রহী করবেন। গণিত, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয় অনুশীলনের সাথে ব্যবহারিক ক্লাসও করাবেন। শিখনফল অর্জিত হয়েছে কি-না তা যাচাইয়ের জন্য পুরো শিখনবস্ত্তর উপর প্রতিফলন ঘটে এমন কিছু প্রশ্ন করবেন। শিখনফলগুলো প্রশ্নবোধক বাক্যে রূপান্তর করলেই এ জাতীয় প্রশ্ন হয়ে যাবে। সৃজনশীল প্রশ্নের আলোকে স্মরণ, অনুধাবন, প্রয়োগ, উচ্চতর দক্ষতা (বিশ্লেষণ, মূল্যায়ন ও সিদ্ধান্ত প্রদান) মূলক প্রশ্ন করবেন। বহুনির্বাচনী প্রশ্নে অনুধাবন, প্রয়োগ ও উচ্চতর দক্ষতা যাচাইয়ের জন্য বহুপদি সমাপ্তি সূচক ও অভিন্ন তথ্য ভিত্তিক প্রশ্ন করবেন। বিভিন্ন প্রকার প্রশ্ন ও সেগুলোর উত্তর লেখার কৌশল সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের সুস্পষ্ট ধারনা দিবেন, যেন তারা প্রতিযোগিতামূলক ও বোর্ড পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করতে পারে।
শিক্ষার্থীরা সঠিক উত্তর দিলে উদ্দীপনামূলক শব্দে তাদের ধন্যবাদ জানাবেন। যেমন বলবেন, ‘ভালো’, ‘খুব ভালো করেছ’, ‘এগিয়ে যাও’, ‘খায়ের’ ‘জাইয়্যেদ জিদ্দান’ ‘good’, very good’ ইত্যাদি। এতে শিক্ষার্থী তার কাজের স্বীকৃতি পাবে এবং শিক্ষার প্রতি অনুপ্রাণিত হবে। না পারলে কাউকে হতাশামূলক ও নেতিবাচক কথা বলবেন না। বরং আরও চেষ্টা করো’, ‘আগামীতে অবশ্যই ভালো হবে’ ইত্যাদি বলে প্রেষণা যোগাবেন। শিক্ষার্থীদের অপারগতা কাটিয়ে উঠতে সাহায্যের জন্যই তো শিক্ষক।
সর্বশেষে বাড়ির কাজ হিসাবে এমন কিছু দিবেন যা শিক্ষার্থী স্বল্প সময়ে সানন্দে করতে পারবে। তারপর শুকরিয়া জানিয়ে পাঠদান শেষ করবেন। শিক্ষার্থীরা নিজেদের মাঝে পঠিত অংশের পুনরালোচনা করবে। আরবীতে একে ‘তাকরার’ করা বলে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে পাঠ্যবিষয়ে বোধগম্যতা তৈরি, পারঙ্গম ক্ষমতা সৃষ্টি এবং তাদের শিক্ষণীয় বিষয়ে পারদর্শী করে গড়ে তোলা শিক্ষকের মূল কাজ। সুতরাং সেভাবে সকল কিংবা অধিকাংশ শিক্ষার্থীকে গড়ে তুলতে পারলে আদর্শ পাঠদান হচ্ছে বলে মনে করা যাবে।
শিশুর পাঠ্যক্রম : পাঠ্যক্রমের অপর নাম শিক্ষাক্রম। এর ইংরেজি প্রতিশব্দ curriculum এবং আরবী প্রতিশব্দ ‘আলমানহাজুদ-দিরাসিয়্যাহ’। পাঠ্যক্রম মূলত শিখন পরিকল্পনা। এতে থাকে শিক্ষার একটি বিশেষ স্তরের (যেমন- প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ইত্যাদি) শিক্ষণীয় বিষয়ের সমষ্টি বা পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা। জাতীয় দর্শন, রাষ্ট্রীয় নীতি, জাতীয় ও বৈশ্বিক চাহিদা ও উপকারভোগী জনগোষ্ঠীর প্রয়োজনীয়তার আলোকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় এটি রচিত হয়। পাঠ্যক্রম সাধারণত সরকারীভাবে পাঠ্যপুস্তক বোর্ড রচনা করে থাকে। তবে বিশেষ বিশেষ শিক্ষা সংস্থা এমনকি ব্যক্তি বিশেষও পাঠ্যক্রম রচনা করতে পারেন এবং করে থাকেন। পাঠ্যক্রম একটি ব্যাপক বিষয়। পাঠ্যবিষয় বা সূচী তার এক একটি অংশ। কোন শ্রেণীতে একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে কী কী বিষয়বস্ত্ত পড়ানো হবে তার বিস্তারিত বর্ণনা বা তালিকা হ’ল পাঠ্যসূচী। এর ইংরেজী প্রতিশব্দ সিলেবাস।
পাঠ্যক্রমে শিক্ষার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, শ্রেণী ভিত্তিক বিষয়গুলোর প্রতিটি অধ্যায় এবং পাঠের সাধারণ ও আচরণিক উদ্দেশ্য লেখা থাকে। সেই সাথে থাকে অর্জনযোগ্য শিখনফলের উল্লেখ এবং মূল্যায়ন কৌশল। শিক্ষার্থীরা কী কী জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী হবে তার বর্ণনাও পাঠ্যক্রমে তুলে ধরা হয়। একজন শিক্ষক পাঠ্যক্রম অনুযায়ী তার প্রদেয় পাঠের আচরণিক উদ্দেশ্য ও শিখনফল জেনে তদনুসারে পাঠদান করতে পারেন এবং মূল্যায়ন বা ফিডব্যাকের মাধ্যমে পড়ানোর মান যাচাই করতে পারেন।
সময়াবদ্ধ বার্ষিক পাঠ পরিকল্পনা : প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বার্ষিক পাঠপরিকল্পনা করতে হয়। সাপ্তাহিক ও সরকারী ছুটির তালিকা বাদে যে দিবসগুলো পাওয়া যায় তা হিসাব করে পাঠ্য দিবস ঠিক করতে হয়। খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ইত্যাদির জন্য ব্যয়িত দিনগুলোর তালিকা ও কর্মসূচী পাঠপরিকল্পনায় রাখতে হবে। পরীক্ষার সংখ্যা, সময়সূচী এবং ফলাফল ঘোষণার তারিখও তাতে উল্লেখ থাকবে। তারপর শ্রেণীকার্যক্রমের দিনগুলো হিসাব করে ধারাবাহিকভাবে কোন মাসের কোন তারিখে পাঠ্যবইয়ের কোন অংশ পড়ানো হবে তা উল্লেখ করে পাঠপরিকল্পনা করতে হবে। এ জাতীয় পাঠপরিকল্পনার নাম সময়াবদ্ধ পাঠপরিকল্পনা। প্রয়োজনে পাঠ পুনরালোচনা করা যাবে। প্রতিষ্ঠান প্রধান কিংবা দায়িত্বপ্রাপ্ত কোন শিক্ষক পাঠপরিকল্পনা মাফিক পড়া হচ্ছে কি-না তা তদারক করবেন এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিবেন। বর্তমানে প্রায় প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিটি শ্রেণীর শিশুদের তাদের নিজস্ব আঙ্গিকে বার্ষিক পাঠপরিকল্পনা সম্বলিত পুস্তিকা প্রদান করে থাকে। এগুলো সময়াবদ্ধ পাঠপরিকল্পনায় রূপান্তর করতে পারলে ভাল হয়। এর ফলে শিশুরা সময়াবদ্ধ পাঠপরিকল্পনা অনুযায়ী তাদের পাঠ এগিয়ে নিতে পারবে।
শিখনফল নির্ণয় : শিক্ষণ-শিখনের সঙ্গে শিখনফল ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বস্ত্তত শিক্ষক তার শিক্ষার্থীদের মাঝে পাঠাদানের মাধ্যমে শিখনফলই সঞ্চারিত করতে চান।
শিখনফলের পরিচয় : কোন একটি পাঠ শেষে শিক্ষার্থীরা কী কী জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করবে সে সম্পর্কে ঐ পাঠের উপর ভিত্তি করে শিক্ষক কিংবা অন্য কারও দ্বারা পূর্ব থেকে নির্ণিত সুস্পষ্ট বর্ণনাই শিখনফল। (দৃষ্টিভঙ্গি হ’ল জীবনকে আপনি কীভাবে দেখেন) শিক্ষক পাঠদানের মাধমে কিছু সুনির্দিষ্ট বিষয়ের পারদর্শিতা শিক্ষার্থীদের মাঝে সঞ্চারিত করতে চান। শিখন কার্যক্রম পরিচালনা শেষে দেখা যায়, সকল শিক্ষার্থী অথবা অধিকাংশ শিক্ষার্থী সে বিষয়ে কাঙ্ক্ষিত পারদর্শিতা অর্জন করেছে। এই পারদর্শিতার বর্ণনাই শিখনফল। শিখলে যা যা ফল বা উপকার পাওয়া যায় তাই শিখনফল। একজন শিক্ষার্থীর বুদ্ধিবৃত্তীয়, আবেগীয় ও মনোপেশীজ ক্ষেত্রসমূহ বিবেচনা করে বিভিন্ন উদ্দেশ্য ও শিখনফল তৈরি করা হয়ে থাকে। শিখনফল হবে SMART অর্থাৎ Specific (সুনির্দিষ্ট), Measurable (পরিমাপযোগ্য, Achivable (অর্জনযোগ্য), Realistic (বাস্তবধর্মী) ও Timing (সময়াবদ্ধ)। শিখন কার্যাবলী এই শিখনফলকে ঘিরে আবর্তিত হয়।
শিখনফল নির্ণয় পদ্ধতি :
১. আজকাল অনেক পাঠ্য বইয়ের শুরুতে শিখনফল লেখা থাকে।
২. লেখা না থাকলে শিক্ষক পাঠ্য অংশের শিখনফল নির্ণয় করবেন।
৩. তিনি সময়াবদ্ধ পাঠপরিকল্পনা অথবা পাঠ্যসূচী অনুযায়ী পাঠদানের অংশ ভালোমতো পড়বেন।
৪. পাঠ্য অংশে পাঠের বিষয়বস্ত্ত ও দক্ষতার আলোকে শিক্ষার্থীদের কী কী শিখনযোগ্যতা বা পারদর্শিতা অর্জনের বিষয় আছে তা চিহ্নিত করবেন এবং ভবিষ্যৎকালের ক্রিয়াবাচক শব্দে শিখনফল লিখবেন। তার ব্যবহৃত ক্রিয়াপদগুলো যেন অবশ্যই সুনির্দিষ্ট, পর্যবেক্ষণযোগ্য ও পরিমাপযোগ্য হয়। যেমন এই পাঠ শেষে শিক্ষার্থীরা তাদের পঠিত অংশ থেকে-
-বলতে পারবে,
-করতে পারবে
-দেখাতে পারবে
-পড়তে পারবে
-লিখতে পারবে
-কারণ চিহ্নিত করতে পারবে
-ব্যাখ্যা করতে পারবে
-উদাহরণ দিতে পারবে
-সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য নির্ণয় করতে পারবে
-তুলনা করতে পারবে
-সূত্র বের করতে পারবে
-পার্থক্য করতে পারবে
-বিশ্লেষণ করতে পারবে
-সংশ্লেষণ করতে পারবে
-মূল্যায়ন করতে পারবে
-মতামত বা সিদ্ধান্ত দিতে পারবে
-যথার্থতা নিরূপণ করতে পারবে
ইত্যাদি ক্রিয়াবাচক শব্দ যোগে শিক্ষক শিখনফল লিখবেন।
৫. সুনির্দিষ্ট, পর্যবেক্ষণযোগ্য ও পরিমাপ বা মূল্যায়নযোগ্য নয় এমন ভাষায় বা ক্রিয়াবাচক শব্দে শিখনফল লেখা যাবে না। যেমন- এই পাঠ শেষে শিক্ষার্থীরা তাদের পঠিত অংশ থেকে জানতে পারবে, বুঝতে পারবে, উপলদ্ধি করবে, শিখতে পারবে, জ্ঞানলাভ করবে, ধারনা লাভ করবে ইত্যাদি ক্রিয়াবাচক শব্দ যোগে শিক্ষক শিখনফল লিখবেন না। কেননা, এই ক্রিয়াগুলোর উপস্থিতি অন্তরের মধ্যে। এগুলো প্রকাশযোগ্য নয়। পর্যবেক্ষণযোগ্য ও পরিমাপযোগ্যও নয়।
৬. শিখনফলগুলো শিখন কার্যাবলী শেষে জ্ঞান, অনুধাবন, প্রয়োগ ও উচ্চতর দক্ষতা (বিশ্লেষণ, সংশ্লেষণ ও মূল্যায়ন) মূলক প্রশ্নের মাধ্যমে যাচাইযোগ্য হবে।
৭. যাচাই বা ফিডব্যাকে শিক্ষার্থীদের থেকে ভাল সাড়া পেলে বুঝা যাবে পাঠদান ভাল হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ শিক্ষার্থী উত্তর করতে না পারলে বুঝতে হবে পড়ানো ভাল হয়নি এবং শিখনফল নির্ণয় যথাযথ হয়নি। কিংবা ক্লাসের পরিবেশ ভাল ছিল না; শিক্ষার্থীরা মনোযোগী ছিল না। শিক্ষককে এ দিকে সতর্ক থাকতে হবে।
শিখনফল নির্ণয়ের গুরুত্ব ও উপকারিতা :
১. পাঠদান থেকে শিক্ষার্থীরা তাদের চাহিদামত কী কী পারদর্শিতা ও যোগ্যতা অর্জন করবে তা শিখনফলে প্রতিফলিত হয়।
২. শিখনফল পাঠটীকার অংশ। শিক্ষার্থীর বয়স ও শ্রেণীভেদে এতে পার্থক্য করতে হয়।
৩. শিক্ষার্থীর চাহিদা, সামর্থ, ও অর্জনযোগ্যতার ভিত্তিতে শিখনফল নির্ণয় করতে হয়।
৪. শিখনফল অনুযায়ী পাঠদানে শিক্ষা ফলপ্রসূ হয়।
৫. শিক্ষক তার কাজে মজা পান এবং বুঝতে পারেন যে তার কাজ সঠিক পথে এগোচ্ছে।
৬. শিক্ষার্থীরা যথার্থ জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করতে সক্ষম হয়।
৭. শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করতে পারে এবং ভবিষ্যতের যোগ্য মানুষ হিসাবে গড়ে উঠতে পারে।
৮. এটি মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করণে ব্যাপক ভূমিকা রাখে।
শিখনফল নির্ণয় থেকে শুরু করে এর ব্যবহার ও উপকারিতা যাচাইয়ে শিক্ষক মূল ভূমিকা পালন করেন। শিক্ষার্থীরা এর সুফল লাভ করে। বিষয়টিতে হেলাফেলা করলে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত হবে না।
শেষকথা : শিক্ষকের মৌলিক দায়িত্ব ও কর্তব্য, শিশুর পাঠদান পদ্ধতি ও শিখনফল নির্ণয়ের ধারণা রাখা একজন শিক্ষকের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ নিবন্ধে উক্ত বিষয়ে যা কিছু আলোচনা করা হয়েছে মহান আল্লাহ যেন তার উত্তম দিকগুলো থেকে আমাদেরকে উপকৃত হওয়ার তাওফীক দেন। ওয়া ছল্লাল্লাহু আলা নাবিয়্যিনা মুহাম্মাদিওঁ ওয়া আলা আলিহী ওয়া আছহাবিহী ওয়া বারাকা ওয়া সাল্লাম।